fbpx
Uncategorizedবাংলাদেশসরকার

ক্যাব প্রস্তাবিত জ্বালানী রুপান্তর নীতি বাস্তবায়নের আহবান বিশেষজ্ঞদের

জ্বালানি রুপান্তর বিষয়ক আলোচনা সভায় বিশেষজ্ঞরা

দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তার লক্ষ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেক বেরিয়ে অতিদ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রুপান্তর হওয়া প্রয়োজন। নতুবা দিনদিন বিদ্যুৎ-জ্বালানির বিদ্যমান সংকট বাড়তেই থাকবে।

বৃহস্পতিবার (৮ মে ২০২৫) জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত জ্বালানি রুপান্তর বিষয়ক এক আলোচনা সভায় এ মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।

‘জ্বালানি সুবিচারে বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২৪ (ক্যাব প্রস্তাবিত)’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা নাগরিক সংগঠন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

ক্যাবের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মিজানুর রহমান রাজুর উপস্থাপনায় জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২৪ (ক্যাব প্রস্তাবিত) নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করেন, ক্যাবের গবেষণা সমন্বয়ক প্রকৌশলী শুভ কিবরিয়া।

তিনি বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল, গ্যাস, কয়লা) থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে (সৌর, পানি বা বায়ু বিদ্যুৎ) যাওয়ার নামই জ্বালানি রুপান্তর। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির দিকে যাওয়া নয়। আমরা একটি সুন্দর বাসস্থানের জন্য ডার্টি এনার্জি তথা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ক্লিন এনার্জি তথা নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যেতে চাই। কিন্তু সরকারের মধ্যে এই ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এসময় ক্যাব প্রস্তাবিত বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২৪ কি বা কেন, এসব দিক ব্যাখ্যা করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, বাংলাদেশের চেয়ে কেনিয়ার মতো দেশও জ্বালানি রুপান্তরের বিষয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে তারা জ্বালানি রুপান্তরে জীবাশ্ম জ্বালানির দিকে না ঝুঁকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে রয়েছে। কারণ, তারা জানে বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকল্প নেই। অথচ বাংলাদেশ অনুসরণ করছে পাকিস্তানের মতো দেশকে, যাদের জ্বালানি রুপান্তর নিয়ে ভাবনা নেই। তিনি আরো বলেন, ক্যাব যে জ্বালানি নীতি প্রস্তাব করেছে সেটি বাস্তবায়ন হলে দেশের জ্বালানি খাতে অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধিত হবে। প্রক্রিত জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত হবে।

ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ফার্নেস অয়েল বা কয়লার ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এইগুলো আমদানীর ক্ষেত্রে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে সহজেই তারা (সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা) অর্থ বিদেশে নেয়া গেছে। আমরা আশা করি, এই বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে সরকার পদক্ষেপ নেবে।

প্রান্তজন এর নির্বাহী পরিচালক তৌহিদুল ইসলাম শাহাজাদা বলেন, বরিশাল এলাকায় (জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক) পাওয়ার প্লান্টগুলোতে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় আমরা পটুয়াখালির পায়রা এলএনজি পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল চেয়েছিলাম। কিন্তু তারপরও সেটা বাতিল হয়নি। অথচ এগুলো এক একটি কার্বন বোমা, যা পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে।

একশনএইড বাংলাদেশ এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জোহরা বিনতে বনি বলেন, গ্রীণ সোসাইটি তৈরির লক্ষ্যে যুবসমাজকে সচেতন করার জন্য ক্যাবের সাথে কাজ করছে একশন এইড। কারণ একটি পরিবেশবান্ধব পৃথিবীর জন্য জ্বালানি রুপান্তর খুবই প্রয়োজন। আর এই রুপান্তর প্রক্রিয়ায় যুব সমাজের ভূমিকা অপরিসীম। আমরা চাই- সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জ্বালানির রুপান্তর প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে।

কক্সবাজার সংসপ্তক এর প্রতিনিধি এস এম রুবেল বলেন, মাতারবাড়ী কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সরকার স্থানীয় মানুষকে তাঁদের প্রাপ্য ক্ষতিপুরন না দিয়েই জমি আধিগ্রহণ করেছে। কিন্তু চাষযোগ্য কৃষি জমি ধ্বংস করে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের ফলে জেলার শস্য উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই ধরনের মেগা প্রকল্পগুলোর প্রভাবে পরিবেশ এর যে বিপর্যয় হচ্ছে, তার ফল স্বরূপ বন্য প্রাণীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত মেগা প্রকল্পগুলি মহেশখালি দ্বীপের বৈচিত্র্য নষ্ট করছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও রাষ্ট্র এখনো জ্বালানি বা পরিবেশের জন্য একটি কাঠামো তৈরি করতে পারে নি। এটা অবশ্যই সরকারের জন্য ব্যার্থতা। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিবেশ তথা সুন্দরবনের জন্য যে ক্ষতিকর, সেটার চিত্র তুলে ধরে আমরা তার প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু তারপরও এটি তৈরি করে পরিবেশের ক্ষতি করা হয়েছে, দুর্নীতির পথ তৈরি করে দেয়া হয়েছে।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, বাংলাদেশে জ্বালানি সুবিচার সংকট কেবল একটি কারিগরি সমস্যা নয়-এটি অধিকার, সাম্য ও সুশাসন ব্যবস্থার প্রশ্ন। এটি আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে, কীভাবে জ্বালানি উৎপাদন, আমদানি, বণ্টন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, যা সব নাগরিকের প্রয়োজন ও মর্যাদাকে প্রতিফলিত করে। সরকার বিদ্যুতের অবকাঠামো ও সংযোগে অগ্রগতি অর্জন করলেও, গঠনগত সমস্যাগুলো এখনো রয়ে গেছে। দুর্নীতি, ব্যয়বহুল সেবা, পরিবেশ ধ্বংস ও বর্জনমূলক নীতি সেইসব মানুষকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, যাদের জন্য জ্বালানি উন্নয়ন/রূপান্তর হওয়া উচিত। নইলে সে রূপান্তর ন্যায্য হয় না, জ্বালানি সুবিচার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে এখন একটি সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর, প্রভাবশালী গোষ্ঠী-নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় এগিয়ে যাবে, নাকি একটি ন্যায্য, গণতান্ত্রিক ও টেকসই জ্বালানি রূপান্তরের পথে হাঁটবে, যেখানে জনগণ তার প্রকৃতি অগ্রাধিকার পাবে। এখন ই সময়-একটি কর্মপন্থা গ্রহণের, যা ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ ও দীর্ঘমেয়াদি সহনশীলতার নীতিতে পরিচালিত হবে। কেবল তখনই বাংলাদেশে সত্যিকারের সুবিচারের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। ক্যাব প্রস্তাবিত বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর’ নীতি ২০২৪ সেই নির্দেশনা দেয়।’

‘এজন্য দরকার বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ক্ষমতায়ন করা, যাতে তারা জ্বালানি রূপান্তরে সুশাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে- এই লক্ষ্যে কর্মপন্থা গৃহীত হতে হবে। জনগণ চায় জ্বালানি খাতের দুর্নীতি দূর করা, গণবান্ধব জ্বালানি রুপান্তর নীতির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা, এবং ন্যায়সঙ্গত জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার করে পক্ষপাতহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও স্বচ্ছ নজরদারি নিশ্চিত করার মাধ্যমে তা করা সম্ভব। দক্ষ একাডেমিক ও গবেষক সম্প্রদায় যদি সেসব ক্ষেত্রে এআই-ভিত্তিক সমাধানগুলোতে অবদান রাখে এবং ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে তা যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহলে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহায়তায় জ্বালানি খাত ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা, নিয়ন্ত্রণ এবং নজরদারির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আরও কার্যকরভাবে করতে পারবে। তাতে ন্যায্য জ্বালানি রুপান্তর নিশ্চিত হবে। জনগণের জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণ হবে। তারা জ্বালানি সুবিচার পাবে।’

এসময় তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বারবার বলছি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে আমাদের লিখিত জানান। আমরা আইনী প্রক্রিয়ায় যাবো। কিন্তু মাত্র একজন ছাড়া আর কেউ তা করেনি। শুধু এখানে মুখে বললে হবে না, আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করুণ। আমরা সেই একজনের অভিযোগ নিয়ে আদালতে গিয়েছি, শীঘ্রই তার রায় পাবো। আশা করছি- আমাদের পক্ষেই পাবো।’

‘শুধু পরিকল্পনা দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। কারণ বর্তমানে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানই (সরকারি-বেসরকারি) অলিগার্ক শ্রেণিতে পরিনত হয়েছে। কিন্তু এমন একটাও এনজিওকে আমি খুঁজে পাইনি, যারা দেখিয়ে দিতে পারছে- কোথায় হাত দিলে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’

‘ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন) প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা করে মুনাফা করছে। কিন্তু দেশে সেই টাকার প্রাইস এডজাস্টমেন্ট (জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়) করা হচ্ছে না। ক্যাব চায় ভোক্তাবান্ধব জ্বালানি নীতি তৈরিতে সরকারকে সহায়তা করা। ফান্ডে অলস টাকা ফেলে না রেখে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে ব্যয় করতে পারে সরকার।’

সমাপনী বক্তব্যে ভোক্তাবন্ধব রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরিতে সকলের সহযোগীতা কামনা করেন, ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া এবং উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ দেয়ার মাধ্যমে আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

 

এসআর

সংশ্লিষ্ট খবর

Back to top button