লিমার বায়ুদূষণ মোকাবিলায় ফগ ক্যাচার
সিঁড়ি ভাঙার মতো দৈনন্দিন কাজ করতেও পেদ্রো মাতাকে বেশ বেগ পেতে হয়৷ ৭৪ বছর বয়সি অবসরপ্রাপ্ত এই মানুষটি লিমা শহরের লাখ লাখ মানুষদের অন্যতম, যারা শ্বাসযন্ত্রের রোগ, তীব্র সংক্রমণ অথবা হার্টের সমস্যায় ভুগছেন৷ পৌর কর্তৃপক্ষের সূত্র অনুযায়ী সে কারণে প্রতি বছর কয়েকশ মানুষের মৃত্যু ঘটছে৷ পেরুর রাজধানী শহর বিশাল স্বাস্থ্য সমস্যায় জর্জরিত৷
পেদ্রো সপ্তাহে একবার চেকআপের জন্য হাসপাতালে যান৷ সেখানকার চিকিৎসা ও বাড়তি ওষুধের কল্যাণে তাঁর জীবনযাত্রার মানে কিছুটা উন্নতি এসেছে৷ তাঁর ডাক্তার রেনাটো কাসানোভা বলেন, ‘‘আমাদের এবং লিমার অন্য হাসপাতালে ঠিক ডন পেদ্রোর মতোই অনেক মানুষ আছেন, যাদের ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ রয়েছে৷ এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কখনো ধূমপান করেন নি, করে থাকলেও সামান্য মাত্রায় করেছেন৷ অন্যান্য দেশের বেশি মাত্রায় ধূমপান করা মানুষের সঙ্গে তাঁদের অবস্থার মিল রয়েছে৷ বিভিন্ন গবেষণায় উল্লিখিত এই রোগের সঙ্গে আমরা পরিবেশ দূষণের যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছি৷”
প্রায় এক কোটি জনসংখ্যার শহর হিসেবে লিমা বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছে৷ মূলত পরিবহণ ও শিল্পখাত এই অবস্থার জন্য দায়ী৷ ফাইন ডাস্ট বা সূক্ষ্ম ধূলিকণার দূষণের মাত্রার বিচারে ২০২২ সালে লিমা ল্যাটিন অ্যামেরিকায় দ্বিতীয় স্থান দখল করেছিল৷ প্রথম স্থানে ছিল চিলির সান্তিয়াগো শহর৷ কিন্তু সরকারি উদ্যোগে বাতাসের মান পরিমাপ অপর্যাপ্ত হওয়ার কারণে অনুমান করা হচ্ছে, যে বাস্তবে বায়ু দূষণের মাত্রা আসলে অনেক বেশি৷
পেরুর ‘কাইরা’ নামের কোম্পানি এর সমাধানসূত্র খুঁজছে৷ লিমা শহরের বায়ু দূষণ সংক্রান্ত তথ্য সবার নাগালে আনার লক্ষ্যে তারা সস্তার পরিমাপ যন্ত্র ও এক ডিজিটাল টুল সৃষ্টি করেছে৷ কোম্পানির প্রতিনিধি মোনিকা আবার্কা জানালেন, ‘‘আমরা এখন লিমার উপর জুম করলে এমন তথ্য পাবো, যা নজরদারি নেটওয়ার্কে সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে৷ সবুজের অর্থ ভালো, হলুদ মানে মাঝামাঝি অবস্থা এবং কমলা ও লাল রং খারাপ অবস্থা দেখাচ্ছে৷ দুই দশমিক পাঁচ সবচেয়ে খারাপ পরিমাপ৷ এর অর্থ আড়াই মাইক্রোমিটার বস্তুকণা৷ সেটাই সবচেয়ে খারাপ৷ এ ক্ষেত্রে অতি ক্ষুদ্র কণা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে৷ তার একটা অংশ রক্ত সঞ্চালনের মধ্যে নিজস্ব স্থান করে নেয়৷”
এই সব তথ্যের ভিত্তিতে পৌর কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নির্গমন কমাতে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারছে৷ তবে লাখ লাখ মানুষের এই শহরে এমন পদক্ষেপ অতি সামান্য উন্নতি আনতে পারছে৷
বহু বছর ধরে পরিবেশ অ্যাক্টিভিস্টরা নিজস্ব উদ্যোগে লিমা শহরের আশেপাশের টিলার উপর বৃক্ষরোপণ করে চলেছেন৷ একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর, অন্যদিকে পাহাড়ি টিলা৷ সেগুলিই লিমার একমাত্র ‘প্রাকৃতিক’ সীমা৷ ধুলিকণা ও ভাসমান পদার্থ টেনে নিয়ে গাছপালা বাতাসের মানের উন্নতির ক্ষেত্রে অবদান রাখছে৷ সেইসঙ্গে আরেকটি উদ্যোগও নজর কাড়ছে৷
এক ফগ ক্যাচার নেটওয়ার্কের সাহায্যে পরিবেশ সংরক্ষণকারীরা শীতকালীন কুয়াসা থেকে পানি সংগ্রহ করছেন৷ পরিবেশ অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে নোয়ে নেইরা টক্টো জানালেন, ‘‘এই পানি একেবারেই স্বচ্ছ৷ এই পানি আমরা এটির মতোই অন্যান্য জলাধারে পাঠিয়ে দেই এবং ড্রিপ ইরিগেশনের কাজে ব্যবহার করি৷”
লিমার ‘সবুজ ফুসফুস’ ৪০০ বছর ধরে বননিধনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ শহরের উপকণ্ঠে একের পর এক নতুন বসতি বা শিল্প গড়ে উঠছে৷ কয়েক শতাব্দী ধরে তিলে তিলে গাছ কাটার ফলে শহরের স্বাস্থ্যের উপর কুপ্রভাব পড়ছে৷
পুনর্বনায়নের মাধ্যমে ভূমিক্ষয় মোকাবিলা ও লিমা শহরের ক্ষতি আপাতত কিছুটা সামাল দেওয়া গেলেও বিজ্ঞানীদের মতে, সেই উদ্যোগ যথেষ্ট নয়৷ এর ফলে অতি সামান্য সুফল পাওয়া যেতে পারে৷ জীববিজ্ঞানী হিসেবে ডানিয়েল ভালে বাস্তো মনে করেন, ‘‘পেরু গোটা বিশ্বের নির্গমনের শূন্য দশমিক আট শতাংশের জন্য দায়ী৷ কোনো একদিন যদি আপনি বলেন, যে লিমায় একেবারে কোনো গ্যাস বা ক্ষতিকর পদার্থের নির্গমন ঘটছে না, তা সত্ত্বেও গ্রহের দূষণ কিন্তু চলতেই থাকবে৷ আমরা একা পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধ করতে পারবো না৷ তবে যারা এর ফলে ভুগছেন, তাদের মধ্যে আমরা অবশ্যই থাকবো৷”
পেদ্রো নিজের ব্যথা কমাতে পেরেছেন৷ ডাক্তারের সহায়তায় তিনি এখন নিজের পাড়ার মধ্যে কিছুটা হাঁটাচলা করতে পারেন৷ কিছুটা স্বাধীনতা ফিরে পেয়ে তাঁর মনে বেঁচে থাকার ইচ্ছাও একটু বাড়ছে৷ বাতাসের ভয়ংকর মানের কারণে ভোগা শহরটির জন্য কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে৷ ডয়চে ভেলে
আন্তর্জাতিক ডেস্ক। বাংলা টিভি