fbpx
বাংলাদেশঅন্যান্য

সাহিত্যিক-ছড়াকার যুগান্তর সাংবাদিক পিন্টু আর নেই

দৈনিক যুগান্তরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক ও ছড়াকার আশরাফুল আলম পিন্টু ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

মঙ্গলবার বিকাল ৩টা ৫ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ভোরে স্ট্রোক করেন আশরাফুল আলম পিন্টু।

পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকাল ৩টা ৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

আশরাফুল আলম পিন্টুর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশক, সাবেক মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এবং যুগান্তর সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম। তাৎক্ষণিক শোক বার্তায় তারা মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।

আশরাফুল আলম পিন্টুর মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তার মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাসভবনে নেওয়া হয়। সেখান থেকে আনা হয় তার প্রিয় কর্মস্থল যুগান্তর কার্যালয়ে। সেখানে শেষ শ্রদ্ধা আর ভালাবাসা জানান সহকর্মীরা। যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলমের নেতৃত্বে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়। এসময় যুগান্তরের সব বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন। পরে মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। এরপর অশ্রুসিক্ত নয়নে সহকর্মীরা শেষ বিদায় জানান আশরাফুল আলম পিন্টুকে।

যুগান্তর কার্যালয় থেকে রাতেই গ্রামের বাড়িতে রাজশাহীতে নেওয়া হয় তাকে। সেখানে নামাজে জানাজা শেষে চিরনিন্দায় শায়িত হবেন এই বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক ও ছড়াকার।

আশরাফুল আলম পিনটুর জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৫ মার্চ, বরেন্দ্রভূমি রাজশাহীতে। বাবার নাম কাজী হারেজউদ্দিন আহমেদ। মা আসেমা বেগম। স্কুল জীবনে দেয়ালিকাতে ছড়া লিখে লেখালেখি জীবনের শুরু। মুদ্রিত আকারে লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। ৮ম শ্রেণিতে পড়ার সময় কিশোর পিন্টু ছড়া ‘জয়বার্তা’য় প্রকাশিত হয়। সেই প্রথম, কিন্তু শেষ নয়। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেতে থাকে তার লেখা। রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বার্তা’ ছাপা হয় পিন্টুর প্রথম গল্প, নাম গুল সম্রাট। এরপর শুধু রাজশাহী নয়, ঢাকার বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকাতেও ক্রমশ তার গল্প পাঠকের দৃষ্টি কাড়তে থাকে। দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক কিশোর বাংলা, সংবাদসহ বিভিন্ন পত্রিকার ছোটদের পাতায় তার লেখা প্রকাশ পায়।

গল্পের পাশাপাশি ছড়াও লিখতে থাকেন তিনি। রাজশাহীতে তখন সাহিত্য সংগঠন রবিবাসরীয় সাহিত্য সংসদের ছিল আশরাফুল আলম পিন্টুর নিয়মিত যাতায়াত। সে সময় তার কিছু গল্প নিয়ে নওগাঁর মাসিক পত্রিকা সূর্যমুখীতে ধারাবাহিক আলোচনা লেখা হয়। লিখেছিলেন কবি অধ্যাপক শাহ আলম চৌধুরী। শিরোনাম ছিল, গল্প শোনো গল্প নিয়ে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত দর্শনীর বিনিময়ে ছড়াপাঠের আসরে স্বরচিত একটি ছড়া পড়ে দর্শকদের আলোড়িত করেন তিনি। রাজশাহী সাংস্কৃতিক সংঘ পদ্মা রঙ্গমঞ্চের সদস্যও ছিলেন। অভিনয় করেছেন মঞ্চেও। নিজের মহল্লায় নাটকের নির্দেশনাও দিয়েছেন। গান শিখতে ভর্তি হয়েছিলেন কাকলি ললিতকলা অ্যাকাডেমিতে।

কিন্তু সেটা বেশি দূর এগোয়নি। রাজশাহীর কিছু পত্রিকার প্রচ্ছদও এঁকেছেন তিনি। আঁকাআঁকির জন্য শিশুবয়সে পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশ-জাপান মৈত্রী সমিতি থেকে।
১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় পিন্টুর প্রথম ছড়ার বই ‘তালপাতার বাঁশি।’ বইটি যৌথ ছড়ার বই। পিন্টুর প্রথম শিশুকিশোর গল্পগ্রন্থ ‘শ্মশানতলির সার্কাস’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। প্রথম শিশুকিশোর উপন্যাস ‘টুপিন ভাই জিন্দাবাদ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। তার মোট প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৫০টি। এর মধ্যে শিশুকিশোর উপযোগী গল্প ও উপন্যাস ৩০টি। উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে যথাক্রমে রূপকথা নয় চুপকথা, শ্মশানতলির সার্কাস, পরি আমার বোন, আনন্দবনের পাখিরা, দাদুর বেড়াল, টুপিন ভাই জিন্দাবাদ, ছোট পাখি আর মেঘ, ছোট্টমোট্ট তারা আর ছোট মেয়ে, বড় ভাই ছোট ভাই, কুয়োব্যাঙের একদিন, ধলপহরের আগে, লেজআলা ঘুড়ি ইত্যাদি। ছোটদের জন্য অনুবাদগ্রন্থ শেবার রাণী ও হুদহুদ পাখি, সাহসী বালকসহ আরও কিছু বই।

বড়দের উপন্যাস আর অনুবাদগ্রন্থ রচনার দিকেও মনোনিবেশ ছিল তার। মোট ২৬টি উপন্যাস রয়েছে এই শিশুসাহিত্যিকের। তার মধ্যে একটি অনুবাদগ্রন্থ। এমিল জোলার বিখ্যাত উপন্যাস দি আর্থ অনুবাদ করেন তিনি, যা ১৯৮৭ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়। বড়দের উপযোগী প্রথম মৌলিক উপন্যাস ‘অসভ্য কয়েকজন’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। এছাড়াও মনে মনে, ছায়াপথ, দিন যায় কথা থাকে, তুমি প্রেম আমি ভালোবাসা, অন্য কোথাও, আমার আছো তুমি ইত্যাদি উপন্যাস তার পাঠকপ্রিয় বড়দের উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম।

সম্পাদনা কাজে পিনটুর হাতেখড়ি হয় ১৯৭৯ সালে। সেসময় তিনি রাজশাহী থেকে ‘ছড়া দর্পণ’ নামে এক ছড়া সংকলন সম্পাদনা করেন। এছাড়াও পিনটু ‘কিশোর সাহিত্য’ নামে আর একটি সংকলন সম্পাদনা করতেন। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য ত্রৈমাসিক কিশোর পত্রিকা ‘কিশোর’ এর সম্পাদক হিসেবে তিনি বেশ পরিচিত ও আলোচিত। যার শিল্প সম্পাদক বাংলাদেশের আর এক খ্যাতিমান অংকনশিল্পী ধ্রুব এষ। এ পর্যন্ত ‘কিশোর’ এর মোট ২১টি সংখ্যা পাঠকের হাতে পৌঁছেছে।

আশরাফুল আলম পিন্টু শুধু একজন লেখক নন। লেখক, সাংবাদিক, সম্পাদক এবং সংগঠক। দেশে ছড়ার প্রথম টিশার্ট ম্যাগাজিন ‘খাপছড়া’ এর সম্পাদক ও উদ্যোক্তা ছিলেন পিনটু। ছাত্রজীবনে রাজশাহীতে ‘কিশোর সাহিত্য কেন্দ্র’ নামে এক সংগঠনের সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া সূর্যমুখী শিশুকিশোর সংগঠনের উপপরিচালক ছিলেন। ঢাকায় এসে চাঁদের হাট কেন্দ্রীয় পরিষদের যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ছড়া অ্যাকাডেমি। যার মহাপরিচালক ছিলেন পিন্টু। চেয়ারম্যান ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী।

আশরাফুল আলম পিনটু জীবনজীবিকার জন্য ঢাকায় আসেন ১৯৮৫ সালে। খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম তখন বিটিভিতে। আলী ইমামের সহযোগিতায় বিটিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট রাইটারের কাজ শুরু করেন তিনি। এরপর ১৯৮৬ তে সাপ্তাহিক লাবণিতে রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে লাবণিতে নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৮৮ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিনের জন্য কবি ও শিশুসাহিত্যিক আবু হাসান শাহরিয়ারের প্রকাশনা সংস্থা রূপকথাতে কাজ করেন। এরপর যোগ দেন প্রকাশনা সংস্থা পল্লব পাবলিশার্সে। দৈনিক খবরের সিনে ম্যাগাজিন দেশচিত্র এবং বাংলাবাজার পত্রিকার ফান ট্যাবলয়েড এর নির্বাহী হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। কিছুদিন এনজিওতে কাজেরও অভিজ্ঞতা রয়েছে।

শৈশব বাংলাদেশ নামের এনজিওতে ম্যাটেরিয়াল ডেভলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৯৯ সালে যোগ দেন দৈনিক যুগান্তরে। দীর্ঘদিন যুগান্তররে শিশুকিশোর পাতা আলোর নাচনের দায়িত্ব অত্যন্ত সফলভাবে পালন করেন। সেসময় দৈনিক যুগান্তরকেন্দ্রিক আয়োজন করেছেন বেশ কয়েকটি ছড়াপাঠের অনুষ্ঠান। যেখানে সারাদেশের দুইশতাধিক ছড়াকার অংশগ্রহন করতেন। প্রধান অতিথি হিসেবে সেই অনুষ্ঠানগুলোতে এসেছেন কবি শামসুর রাহমান, বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, কবি আসাদ চৌধুরী, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ প্রমুখ। আলোর নাচনের পাশাপাশি একদিন প্রতিদিন পাতাও দেখতেন তিনি। আশরাফুল আলম পিনটু তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যুগান্তরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক (শিফট ইনচার্জ) হিসাবে কর্মরত ছিলেন।

লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ আশরাফুল আলম পিন্টু পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। তার অনবদ্য সৃষ্টি রূপকথা নয় চুপকথা গ্রন্থের জন্য ২০০৮ সালে অর্জন করেছেন এম নুরুল কাদের পুরস্কার। পরপর দুবার পেয়েছেন ইউনিসেফের মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড। ছোট মেঘ আর পাখি গল্পের জন্য ২০০৯ সালে এবং গাছটা একদিন মানুষ হয়ে গিয়েছিল গল্পের জন্য ২০১০ সালে।

এছাড়া পরি আমার বোন গল্পগ্রন্থের জন্য ২০০৯ সালে পেয়েছেন এম নুরুল ইমান খান সম্মাননা।

সংশ্লিষ্ট খবর

Back to top button