মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তিন বছরের শিশু সন্তান ইয়াসিনকে বুকে জড়িয়ে রেখে পুড়ে মারা গেলেন নাদিরা আক্তার পপি (৩৫)। আগুনের হাত থেকে বাঁচতে ট্রেন থেকে নামার চেষ্টা করেও ভিড় ও ধোঁয়ার কারণে নামতে পারেননি মা-ছেলে। ভোরে রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা যান নারী-শিশুসহ চারজন। তাদের মধ্যে আছেন পপি ও তার ছেলে।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে নিহত পপির ভাই হাবিবুর রহমান বলেন,নেত্রকোণা থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম একই পরিবারের ৯ জন। সোমবার রাতে ট্রেনে উঠি। বিমানবন্দর স্টেশনে আমাদের মধ্যে ৫ জন নেমে যান। ট্রেন বিমানবন্দর থেকে কমলাপুরের উদ্দেশে রওনা করে। আমরা ‘জ’ বগিতে ছিলাম। হঠাৎ ধোঁয়ায় ভরে যায় কামরা। ‘আগুন আগুন’ বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয় চারদিকে। তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেন থামতে থামতে সবাই হুড়োহুড়ি করে নেমে যান। এর মধ্যে আমার বড় ভাগিনা মাহিমকে নিয়ে আমিও নেমে যাই। কিন্তু আমার বড় বোন নাদিরা আক্তার পপি ও তিন বছরের ছোট ভাগিনা ইয়াসিন বের হতে পারেনি।
তিনি জানান, আগুন নেভানোর পর চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে আমার বোন ও ভাগনে ছিল। যখন আমার বোনের মরদেহ উদ্ধার করা হয় তখনও তার বুকে জড়ানো ছিল আমার ভাগনে। দুজন একসঙ্গে পুড়ে মারা গেছে। এসব কথা বলছিলেন আর কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন হাবিবুর রহমান।
নিহত পপির স্বামী মিজানুর রহমান জানান, আমি পেশায় হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী। নেত্রকোণা গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছিল আমার পরিবার। ব্যবসার কাজের জন্য আমার যাওয়া হয়নি তাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার শ্যালক হাবিব ফোন দিয়ে জানায় ট্রেনের তিনটি বগিতে আগুন দেওয়া হয়েছে। শ্যালক ও আমার বড় ছেলে নামতে পারলেও ধোঁয়ার কারণে আটকা পড়ে আমার স্ত্রী ও ছোট ছেলে। আমি ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে দেখি আমার শিশু সন্তানকে কোলে জড়িয়ে ধরে আছে স্ত্রী। তাদের দুজনের শরীর পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, আমি কী অপরাধ করেছি? কী থেকে কী হয়ে গেল… কিছুই বুঝতে পারছি না। আল্লাহ, আমার তো সব শেষ হয়ে গেল। আমি কার কাছে বিচার দেব, আমার ছেলে আর স্ত্রীকে তো আর ফিরে পাব না..।
এসময় মাঝবয়সী বকুল আক্তার নামে আরেক মা তেজগাঁও স্টেশনে নাতনিকে নিয়ে তার ছেলের খোঁজ করছেন। তিনি মোহনগঞ্জ থেকে ট্রেনটিতে আসছিলেন। বকুল আক্তার জানান, মোহনগঞ্জ থেকে ট্রেনটিতে আসছিলেন। হঠাৎ করে দেখা যায় আগুন। আমার পুত (ছেলে) খোকন মিয়াকে খুঁজে পাচ্ছি না। ছেলে পুড়ে গেছে, না মরে গেছে সেটা কি করে বলি। আমার ছেলেকে খুঁজে দাও তোমরা। এভাবেই বিলাপ করতে থাকেন তিনি।
এক সপ্তাহের মধ্যে আবারও ট্রেনে নাশকতা। আবারও লক্ষ্যবস্তু মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস। এবার ট্রেনটির বগিতে আগুন দেন হরতাল সমর্থকরা। এতে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন মা-ছেলেসহ চারজন। ছাই হয়ে গেছে তিনটি কোচ। আগুন নিয়েই বিমানবন্দর এলাকা থেকে ট্রেনটি ছুটে চলে তেজগাঁও পর্যন্ত ট্রেনটি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিমানবন্দর স্টেশন পার হওয়ার পর দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে ট্রেনটি। আতংকিত যাত্রীরা ভেতরে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন। তবে ট্রেনের চালক বুঝতেই পারেননি আগুন লেগেছে। চালক বুঝতে বুঝতে ট্রেনটি চলে আসে তেজগাঁও স্টেশনে। ট্রেন থামার পর যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে ভেতর থেকে নামতে শুরু করেন। তবে তিনটি বগি পুড়ে গেলেও একটির ভেতরে আটকা পড়েন চারজন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তেজগাঁও ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌনে ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, হরতাল সমর্থকরা তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সেপ্রেসে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভোর ৫টা ৪ মিনিটে আমাদের কাছে এ সংবাদ আসে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আমাদের ৩টি ইউনিট পাঠানো হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টার চেষ্টার পর পৌনে ৭টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। একটি বগি থেকে ৪ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
তেজগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন নেত্রকোনা থেকে ছেড়ে আসা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করে অগ্নিসন্ত্রাসীরা। এতে ট্রেনের ৩টি বগি ভস্মীভূত হয়। ট্রেনটি এয়ারপোর্ট ছেড়ে খিলক্ষেত আসলে যাত্রীরা আগুন দেখতে পান। এরপর সবাই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে ট্রেনচালক তেজগাঁও এসে ট্রেন থামান। পরে ফায়ার সার্ভিসে খবর দিলে তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের ৩টি ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। একটি বগি থেকে চারজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
বাংলা টিভি/এএইচএমএফ