fbpx
বাংলাদেশঅপরাধ

এমপি আনোয়ারুল আজিমকে হত্যা করে খণ্ডবিখণ্ড করা হয়েছে

স্বীকারোক্তি ক্যাবচালকের

কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া একজন ক্যাবচালক জানিয়েছে, এক সপ্তাহ আগে নিখোঁজ হওয়া বাংলাদেশের বাংলাদেশের ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে হত্যা করা হয়েছে এবং মরদেহ দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

কলকাতা বিধান নগর পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মানব শ্রিংলা বলেছেন, “ ক্যাব চালক স্বীকারোক্তি দিয়েছে ১৩ই মে যে ব্যক্তিকে সে গাড়িতে তুলেছিল তাকে হত্যার পর টুকরা টুকরা করে লাশ ছড়িয়ে দিয়েছে”।

তবে তাকে হত্যা করা হয়েছে কিনা, অথবা মরদেহ পাওয়া গেছে কিনা, সেই বিষয়ে কলকাতার পুলিশ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।

পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যে ফ্ল্যাটে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, সেটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। সেখানে কাউকে এখনও ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।

পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, ওই ফ্ল্যাটে তিনজনকে ঢুকতে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। এদের মধ্যে একজন মহিলা। তবে ওই তিন জনকে সেখান থেকে বের হতে আর দেখা যায় নি।

কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিবা টাউনের একটি ফ্ল্যাট ঘিরে রেখেছে পুলিশ। সেখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এই ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্যের মরদেহ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেছেন, আনোয়ারুল আজিমের মরদেহ উদ্ধারের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে কলকাতা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

আনোয়ারুল আজিমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন সকালে কলকাতায় ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন বলে নিশ্চিত করেছে কলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশন।

এর আগে ২০শে মে আনোয়ারুল আজিমের খোঁজ করতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করেছিল।

তারা জানতে পেরেছে কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গিয়েছিল সেখানকার নিউমার্কেট এলাকায়। এরপর ১৭ই মে তার ফোন কিছুক্ষণের জন্য সচল ছিল বিহারের কোনও জায়গায়।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এই তথ্য পেয়েছে কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস কর্তৃপক্ষ, এমনটাই জানিয়েছিলেন উপ-দূতাবাসের এক কর্মকর্তা, যিনি তার নাম প্রকাশ করতে চাননি।

কলকাতার উত্তর শহরতলি বরাহনগর এলাকার সিঁথিতে যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন আনোয়ারুল আজিম, সেই গোপাল বিশ্বাস জানিয়েছেন যে, ১৩ই মে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যে ভাড়া করা গাড়িতে উঠেছিলেন আনোয়ারুল আজিম, সেটির চালকের সন্ধান পেয়েছে বলেই স্থানীয় পুলিশের তরফে তাকে জানানো হয়েছে।

“পুলিশের কাছে আমি নিখোঁজ ডায়েরি করেছিলাম। তারা ওই গাড়িটিকে খুঁজে বার করেছে আর চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ওই চালক নাকি পুলিশকে জানিয়েছেন যে সংসদ সদস্যের সঙ্গে একজন বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন। এদের দুজনকে তিনি কলকাতা সংলগ্ন নিউ টাউন এলাকায় ছেড়ে দেন ১৩ই মে,” জানাচ্ছিলেন গোপাল বিশ্বাস।

এর বাইরে এখন পর্যন্ত নিখোঁজ সংসদ সদস্যের ব্যাপারে আর কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।

২০শে মে উপ-দূতাবাসের তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেস সচিব রঞ্জন সেন জানিয়েছেন, “বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সংসদ সদস্যের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের শনিবার জানানো হয়। তারপরই আমরা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা খোঁজখবর করছেন এমনটাই আমাদের জানানো হয়েছে।”

আবার শেষবার যেহেতু নিখোঁজ সংসদ সদস্যকে কলকাতায় দেখা গিয়েছিল, তাই কলকাতা পুলিশের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ রাখছিল বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস।

ডাক্তার দেখাতে বের হন তিনি

কলকাতার সিঁথি অঞ্চলের বাসিন্দা, ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাস এর আগে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, আনোয়ারুল আজিমের সঙ্গে দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে তার পারিবারিক সম্পর্ক।

গোপাল বিশ্বাস বলছিলেন, “এবারে তিনি এসে আমাকে বলেছিলেন যে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাবেন। কোন ডাক্তার ভালো হবে, সেটাও জানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার জানাশোনা কোনও স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ নেই, তাই আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম সল্ট লেকের অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারেন”।

“ আমরা একসঙ্গে সকালের জলখাবার খেয়েছিলাম। তারপরে এটাও তাকে বলেছিলাম যে আমার গাড়ি সেদিন নেই, উনি যেন গাড়ির বন্দোবস্ত করে নেন। এরপরে আমি বাড়ির একতলায় অফিসে চলে আসি।”

“এরপর আমি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দুপুরে বেরনোর সময়ে আমাকে বলে যান যে তিনি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবেন। তার খোঁজ না পাওয়ার পরে আমি যখন সিসিটিভি ফুটেজ দেখি, তখন জানতে পারি যে উনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন দুপুর একটা ৪১ মিনিটে,” বলছিলেন গোপাল বিশ্বাস।

বরাহনগর থানায় যে নিখোঁজ ডায়েরি করেছেন গোপাল বিশ্বাস সেখানে তিনি লিখেছেন, তার বাড়ির অদূরে বিধান পার্ক এলাকা থেকে ভাড়ার গাড়িটিতে ওঠেন আনোয়ারুল আজিম। তাকে গাড়িতে উঠতে দেখেছেন, এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কথাও পুলিশকে জানিয়েছেন মি. বিশ্বাস।

সন্ধ্যায় বন্ধুর বাড়িতে ফিরে আসার কথা থাকলেও সেখানে ফেরেননি আনোয়ারুল আজিম।

হোয়াটস্অ্যাপে ১৩ই মে তিনি মেসেজ পাঠান যে “বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যাচ্ছি এবং পৌঁছে ফোন করবো, তোমাদের ফোন করার দরকার নেই।”

ডাক্তার দেখাতে বের হয়ে দিল্লিতে?

কলকাতার গোপাল বিশ্বাসের গহনা রফতানির ব্যবসা আছে। তিনি জানাচ্ছিলেন, দুই আড়াই দশকের বন্ধুত্ব সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের সঙ্গে।

“বাংলাদেশে বিএনপির জমানায় ও ভারতে থাকত। আমাদের বাড়ি মাঝদিয়ায়। সেখানে সুভাষ আগরওয়ালের বাড়িতে থাকত আনার। আমার সঙ্গে সেখানেই পরিচয়, তারপরে বন্ধুত্ব। সম্পর্কটা এখন পারিবারিক স্তরে চলে গেছে,” জানালেন গোপাল বিশ্বাস।

সে কারণেই চিকিৎসা করাতে এসে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন আনোয়ারুল আজিম।

সেদিন দুপুরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরে আনোয়ারুল আজিম যে ভাড়াচালিত গাড়িতে উঠেছিলেন সেটির চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।

new town apartment
নিউ টাউনের এই অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স থেকে এই বাড়িটি ঘিরে রেখেছে পুলিশ

এরপর গোপাল বিশ্বাসকে পুলিশ জানিয়েছে, আনোয়ারুল আজিমের সাথে আরেকজন বাংলাদেশি নাগরিককে নিউ টাউন অঞ্চলে ছেড়ে দেয়ার কথা জানিয়েছেন ওই চালক।

এরপর ১৫ই মে সকালে গোপাল বিশ্বাস আনোয়ারুল আজিমের কাছ থেকে আবারও একটি হোয়াটস্অ্যাপ মেসেজ পান যে তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন এবং তার সঙ্গে ‘ভিআইপিরা’ আছেন, তাই তাকে যেন ফোন না করা হয়।

এর দু’দিন পরে, ১৭ই মে গোপাল বিশ্বাসকে আনোয়ারুল আজিমের মেয়ে ফোন করে জানান যে তার বাবার সঙ্গে কিছুতেই তারা যোগাযোগ করতে পারছেন না।

“সে খবর জানতে পেরে কলকাতায় ওর যত ঘনিষ্ঠ মানুষ আছেন বলে আমি জানি, সবাইকে বিষয়টা জানাই। তারাও খোঁজ খবর করতে শুরু করেন। কিন্তু কোনোভাবেই আজিমকে ফোনে পাওয়া যায়নি,” বলছিলেন গোপাল বিশ্বাস।

পরের দিন, ১৮ই মে বরাহনগর থানায় যান তিনি।

গোপাল বিশ্বাস বলেন, “সেখানে আমাকে সারাদিন বসিয়ে রাখা হয়। পুলিশ আমার বাড়িতে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। সেসব খতিয়ে দেখে আমার নিখোঁজ ডায়েরি নেওয়া হয়। তারা ওই ভাড়ার গাড়িটির নম্বরও পেয়ে যায়। চালকের সঙ্গে কথা বলেছে। নিশ্চয়ই পুলিশ খোঁজখবর করছে, আমাকে তো আর সব তথ্য জানাচ্ছে না।”

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশের উপ-দূতাবাস যে তথ্য পেয়েছিল, সে অনুযায়ী ১৭ই মে মি. আজিমের মোবাইল নম্বরটি কিছুক্ষণের জন্য বিহারে অবস্থান করছিল।

আবার এটাও জানতে পেরেছে তারা যে মোবাইল সেট থেকে সিম কার্ডটি আলাদা করে রাখার কারণে সঠিক অবস্থান খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এর আগে, ঢাকায় ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, “ তার দুটি বাংলাদেশি নম্বর আছে আর একটি ভারতের নম্বর। আমরা ভারতীয় পুলিশের সহযোগিতায় তার ভারতীয় নম্বরটি দেখলাম মুজাফফরাবাদ অর্থাৎ বিহারের দিকে।“

ঘটনাচক্রে বিহারে মুজাফফরাবাদ নামের জায়গা নেই। পাকিস্তান শাসিত জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানীর নাম মুজাফফরাবাদ, আর প্রায় কাছাকাছি যে নামের জায়গা বিহারে আছে, সেই জায়গার নাম মুজফ্ফরপুর।

ডিবির প্রধান সেদিন জানিয়েছেন, “আমরা বিষয়টার খোঁজখবর রাখছি। ভারতের যারা বাংলাদেশে আছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলছি, আবার ভারতীয় পুলিশের সঙ্গেও কথা বলছি। উনার পরিবারও যোগাযোগ রাখছে আমাদের সঙ্গে। তার মেয়ে আমাদের কাছে এসেছিলেন।”

ডিবি কার্যালয়ে বাবার নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন সংসদ সদস্যের কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। বিবিসি

বাংলা টিভি / এমএএইচ

 

সংশ্লিষ্ট খবর

Back to top button