নিজস্ব প্রতিবেদক: অনলাইনে ডলার বিনিয়োগ করলেই প্রতিদিন আয় করা যাবে ডলার, এমনই প্রলোভনে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। চক্রের মূল হোতা জাকিরের নামে হয়েছে মামলা।
ঘটনাটি ঘটেছে দিনাজপুরের বোচাগঞ্জের একটি গ্রামে। প্রতারক চক্রটি দিনাজপুর শহরে অবস্থান করে আশেপাশের গ্রামগুলোর সহজ সরল মানুষদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে অনন্ত দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা। ভূক্তভোগী অনেকেই এখন নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
প্রতারকচক্রের শিকার একজন মোছাঃ তৃণা মনি। তৃণা মনির বাড়ি দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ থানার জিনগাঁওয়ে। জাকিরের বরাত দিয়ে তৃণা মনি জানান, আমেরিকান একটি কোম্পানির ওয়েবসাইটে রিচার্জ করতে হবে কমপক্ষে ৫০০ ডলার। ১ হাজার ডলার রিচার্জ করলে দৈনিক ইনকাম হবে ১০ থেকে ১৫ ডলার। এমন সব লোভনীয় অফার ও আশপাশের অনেক মানুষের এভাবে ডলার আয় করতে দেখে তিনিও খোলেন একটি একাউন্ট। টাকা হাতে হাতেই গ্রহণ করতেন মোঃ জাকির হোসেন নামের প্রতরক চক্রের মূল হোতা। এভাবে পরবর্তীতে ধীরে ধীরে স্থানীয় অনেক মানুষকে তার শিকার বানিয়ে হাতিয়ে নেন ২ কোটির টাকা উপরে। তৃণা মনির মত আরো অনেকেই প্রতারনার শিকার হয় জাকিরের ফাঁদে পা দিয়ে। এ ব্যাপারে মোছাঃ তৃণা মনি একটি মামলা দায়ের করেছেন । যার মামলা নং- ৩৬/২৪ সি (বোচাগঞ্জ)।
কে এই জাকির হোসেন বা মোঃ জাকির হোসেন? জাকির পেশায় একজন চাকুরিজীবী। তিনি বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘পিওর এগ্রো কেয়ার’ নামে নিজেই এ প্রতিষ্ঠান। তবে তার প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। জাকির হোসেন পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের মৃত: হাফিজ উদ্দিন এর ছেলে। বর্তমানে তিনি বসবাস করছেন দিনাজপুর শহরের উত্তর মুন্সিপাড়া ষ্টেশন রোড এলাকায়। মোঃ জাকির হোসেন এর নামে ভেজাল ও অবৈধ সার বিক্রয়ের বিষয়েও একটি মামলা রয়েছে।
ঘটনার অনুসন্ধানে জানা যায়,মোঃ জাকির হোসেন (Global-Hero-FX এর কমিউনিটি গ্রুপ এডমিন) জৈব সার উৎপাদক কোম্পানির চাকরি করার সুবাদে হাটরামপুর বাজারস্থ এলাকায় তার বেশ যাওয়া আসা। এই সুযোগে গ্রামের সহজ সরল মানুষকে প্রলুব্ধ করে অনলাইনে ডলার ইনকাম করা যায়, ব্যাপারটি বোঝাতে বেশি সময় লাগেনি তার। প্রথমে কিছু সহজ সরল মানুষকে একাউন্ট খুলে দিয়ে ডলার জমা ও ডলার উত্তোলনও করে দিয়েছেন। এভাবে ধীরে ধীরে ডলার জমা ও উঠানোর মধ্যে দিয়ে অনেকেই বেশি লাভের আশায় জমা করেছেন অনেক পরিমান অর্থ। যাদের বোকা বানিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, তাদেরই আবার দিয়েছে বিভিন্ন পুরস্কারও।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, মোঃ জাকির হোসেন ও তার অনুসারীরা দিনাজপুর শহরের বিভিন্ন হোটেলে মানুষকে প্রলুদ্ধ ও উৎসাহিত করতে আয়োজন করেছেন পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠান। সেখানে যারা বেশি পরিমাণে সদস্য বাড়িয়েছেন, তাদের মাঝে দেওয়া হয়েছে দামি পুরস্কারও। তবে অনুষ্ঠানের সময় তোলা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোন মাধ্যমে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নিষেধ করা হতো। সেখানে দেখানো হয়েছে বিদেশী ভিডিও। যার প্রমাণ রয়েছে এই প্রতিবেদকের কাছে। সেখানে দেখা যায়, COS (VIP-2) International নামে (মামলার নথি অনুসারে) হোয়াটসঅ্যাপে Global-Hero-FX গ্রুপ ওপেন করে বিভিন্ন সময়ে অনলাইনে গ্রুপ মিটিং করে থাকে। সেখানে দেখা যাচ্ছে শুধু মাত্র একটি গ্রুপ নয় আরো কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে যার স্ক্রিনশর্টও সামনে আসে।
বাদি মোছাঃ তৃণা মনির করা মামলায় আসামী করা হয়েছে মোঃ জাকির হোসেনকে। এ মামলায় স্বাক্ষী করা হয়েছে ৪ জনকে। স্বাক্ষী ও বাদি জানান, উল্লেখিত মাধ্যম ছাড়াও আরো কয়েকটি মাধ্যম দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয় জাকির চক্র। এছাড়াও চক্রটি বিভিন্ন ভার্চুয়াল কারেন্সির নামে মানুষের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। জাকির হোসেনের সাথে জড়িত যাদের নাম পাওয়া যায়,তাদের মধ্যে রয়েছে, আরেফিন শাওন, এমকেএম উলি উল্লাহ, আরিফুর রহমান, জাবেদ, মোঃ আব্দুল হালিম, মোঃ আতাউর রহমান, মোঃ জিয়াউল হক ও কাশেম চৌধুরীসহ অনেকে। এদের মধ্যে বিভিন্ন ওয়েবসাইট তৈরি,কম্পিউটার সাপোর্ট ও এ্যাপ তৈরিতে সহযোগিতা করে বিপ্লব নামের এক ব্যক্তি। আর রংপুর বিভাগসহ বিভিন্ন এলাকায় সদস্য সংগ্রহের কাজে সহযোহিতা করছেন একে আজাদ। এছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করে জাকির হোসেনের স্ত্রী মোছাঃ মাফরুজা বেগম।
মামলার নথি অনুযায়ী অভিযোগ আনা হয়েছে ০১/১০/২০২৩ তারিখে। তাতে বাদি মোছাঃ তৃণা মনির কাছ থেকে মোঃ জাকির হোসেন ডলার জমা করার কথা বলে ৫০০ ডলার, রাসেল রানার কাছ থেকে ১০০০ ডলার,তৌহিদুল ইসলাম এর কাছ থেকে ১৫০০ ডলার, মোঃ জিহাদ হাসান এর কাছ থেকে ৭০০ ডলার ও মোঃ সামসুদ্দিন এর কাছ থেকে ৫০০ ডলার সমমূল্যের অর্থ গ্রহণ করেন।
মামলার নথিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, একটা পর্যায়ে ওয়েবসাইট বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে আর কোন তথ্য পাওয়া যায় না। টাকা লেনদেনের ব্যাপারটি সুরহা করার জন্য ১৫/০১/২০২৪ তারিখে আসামী মোঃ জাকির হোসেন এবং বাদি ও স্বাক্ষীরা একত্রিত হয় রামপুর বাজারস্থ মসজিদের সামনে। সেখানে মিমাংসার লক্ষ্যে গ্রহণকৃত টাকা ফেরত চাইলে সেখান থেকে পালিয়ে যায় জাকির হোসেন। পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে বাদি ও স্বাক্ষীদেরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে যাচ্ছে অভিযুক্ত জাকির হোসেন।
বাদি মোছাঃ তৃণা মনি জানান, আপোষ-মিমাংসার মাধ্যমে টাকা ফেরত না পাওয়া তিনি বাধ্য হয়ে মামলা করেন। আর এভাবেই জাকির চক্রের চক্রের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষেরা।
এসআর